আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলো ব্যাপক ঝড় ও ভারী বৃষ্টিপাতের শিকার হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) গত দু’দিনে টানা বৃষ্টিপাত হয়েছে। ৭৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এ বৃষ্টিপাতে মরুভূমির দেশটির বিভিন্ন স্থানে বন্যা দেখা দিয়েছে। ফলে আকস্মিক এ বন্যায় বিশ্বের দ্বিতীয়-ব্যস্ততম বিমানবন্দর তথা দুবাই বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও ছোট-বড় শহরের চারদিকে থই থই পানির কারণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে।
ফ্লাইট বাতিল-বিলম্ব ও যাত্রীদের নানা বিড়ম্বনার মধ্যে দুবাই বিমানবন্দরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
এ দিন দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলেছে, তারা ‘খুবই চ্যালেঞ্জিং অবস্থার’ সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়া দুবাইয়ের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কিছু যাত্রীকে বিমানবন্দর থেকে না যাওয়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছে।
বন্যার পানিতে গাড়ি পড়ে যাওয়ার পর আরও একজন লোক মারা গেছেন। এতে করে এখন পর্যন্ত দেশটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ জনে।
বিবিসি বলছে, বুধবার গ্রিনিচ মান সময় রাত ৯টায় (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার ভোর তিনটায়) ফ্লাইট অ্যাওয়্যার-এর ডেটা অনুসারে, দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় ২৯০টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। একই সময়ে আরও ৪৪০টি ফ্লাইট বিলম্বিত ছিল।
দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি সারা বিশ্বের যাত্রীদের জন্য ব্যস্ততম এয়ার হাব হিসেবে পরিচিত। গত বছর বিমানবন্দরটি ৮০ মিলিয়নেরও বেশি যাত্রীদের পরিষেবা দিয়েছে এবং যাত্রী পরিষেবার দিক থেকে এটি যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে বলেছে, পরিষেবা পুনরুদ্ধারে আরও ‘কিছু সময়’ লাগবে। এছাড়া বিমানবন্দর থেকে দেওয়া সর্বশেষ আপডেটে এয়ারলাইন্স থেকে নিশ্চিতকরণ ছাড়া ১ নং টার্মিনালে যাওয়া এবং বিমানবন্দরে ভ্রমণ এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন হচ্ছে এমিরেটস। এই সংস্থাটির সদর দপ্তরও দুবাইয়ে এবং বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জনপ্রিয় এই পর্যটন শহর থেকে ছেড়ে যাওয়া যাত্রীদের জন্য চেক-ইন স্থগিত করেছে তারা।
আরও বজ্রপাত, ভারী বৃষ্টি এবং শক্তিশালী বাতাসের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, অনেক নিচু এলাকা এখনও পানির নিচে রয়েছে বলে সতর্ক করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
ওমানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাত ৭৫ বছর আগে রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে গত মঙ্গলবার সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত প্রত্যক্ষ করেছে। ন্যাশনাল সেন্টার অব মেটিওরোলজি ঘোষণা করেছে, ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আল-আইন অঞ্চলের খাতম আল-শাকলায় ২৫৪.৮ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে বছরে গড় ১৪০-২০০ মিমি বৃষ্টিপাত হলেও দুবাইয়ে বছরে সাধারণত মাত্র ৯৭ মিমি বৃষ্টিপাত হয়। আর এপ্রিল মাসের মাসিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ৮ মিমি। গত মঙ্গলবার ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে এই বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা বিপজ্জনক হওয়ার কারণে অসংখ্য আগত ফ্লাইট সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
মূলত ঝোড়ো বাতাসের কারণে বিমানবন্দরটিতে ফ্লাইট ওঠানামায় বিঘ্ন ঘটে। এই অবস্থায় একের পর এক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট হয় বাতিল, নয়তো তার শিডিউল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো।
এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের ভেতরেই প্লাবিত রানওয়েতে বিমানগুলো ট্যাক্সি করছে। এছাড়া বিমানবন্দরের পার্কিং লটে গাড়িগুলোকে অর্ধেক ডুবে থাকতে দেখা গেছে। এমনকি বিমানবন্দরের দিকে যাওয়ার রাস্তাগুলোও পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়া দুবাই মল এবং মল অব দ্য এমিরেটসের মতো ফ্ল্যাগশিপ শপিং সেন্টারসহ শহরের মূল অবকাঠামোগুলোও প্লাবিত হয়েছে এবং দুবাইয়ের অন্তত একটি মেট্রো স্টেশনকে গোড়ালি-গভীর পানিতে প্লাবিত হতে দেখা গেছে। অনেক স্থানে রাস্তা ধসে পড়েছে, আবাসিক এলাকাও নিমজ্জিত হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে বাড়ির ছাদ, দরজা এবং জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেইসাথে দুবাইয়ে ১২-লেনের মহাসড়কের কোথাও কোথাও দীর্ঘ যানজটও দেখা গেছে।
দুবাইয়ে মূল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকা পড়া বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ পর্যটকদের মধ্যে রয়েছেন কেট এবং অ্যান্ড্রু গোল্ডিং। তারা ১২ ঘণ্টা ধরে সেখানে ছিলেন। ৬২ বছর বয়সী অ্যান্ড্রু বিবিসি নিউজকে বলেছেন, ‘আমি অন্য ফ্লাইটে যাওয়ার চেষ্টা করছি’। কেন্টের এই দম্পতি কেটের ৬০ তম জন্মদিন উদযাপনের জন্য দুবাইতে এসেছিলেন। আর এই ভ্রমণকে অ্যান্ড্রু বলছেন, তিনি ‘কখনও ভুলবেন না’।
অ্যান্ড্রু বলেন, এখানকার অবস্থা আমার মনে হয় যে কারও প্রত্যাশার চেয়েও খারাপ, বিমানবন্দরের সিস্টেমটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে এবং এমিরেটস, যাকে আমি সেরা এয়ারলাইনগুলোর মধ্যে একটি বলে মনে করি- এখানে কোনও কর্মী নেই, কোনও তথ্য নেই, কোনও সমন্বয় নেই, কোনও পেশাদারিত্ব নেই, কোনও পরিষেবা নেই। এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ছে কী করতে হবে সেই দুর্যোগ পরিকল্পনাও এমিরেটসের নেই। এটি অদ্ভুত। বড় কোম্পানিগুলো সাধারণত এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য আগেই পরিকল্পনা করে রাখে।
তিনি আরও বলেন, এখানে সম্পূর্ণরূপে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। লোকেরা লাউঞ্জে, মেঝেতে ঘুমাচ্ছে এবং খাবারের প্যাকেট সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এটি সত্যিই একটি সুন্দর নোংরা অভিজ্ঞতা।
বিমানবন্দরের অন্য স্থানে দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারের রদারহ্যাম থেকে আসা অ্যান উইং তার স্বামী এবং তিন সন্তানের সাথে লন্ডন হিথ্রোতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করছেন। তারা তাদের ১১:২৫ মিনিটের ফ্লাইটের জন্য স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় বিমানবন্দরে পৌঁছান এবং প্রাথমিকভাবে তাদের বলা হয়েছিল, ফ্লাইটটি এক ঘণ্টা দেরি হয়েছে।
Leave a Reply