মানবতার কন্ঠ ডেস্ক:
টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢলে দেশের কয়েক জেলায় দেখা দিয়েছে বন্যা পরস্থিতি। সিলেট, শেরপুর, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও নেত্রকোনার কলমাকান্দায় বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সাজেকে আটকা পড়েছেন শতাধিক পর্যটক। খাগড়াছড়িতে পাহাড় ধসের কারণে ৫ ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিলো। সড়কে ফাটল দেখা দিয়েছে। ডুবে গেছে ৩৫ গ্রাম। সিলেটের গোলাপগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়াও বান্দরবানের থানচিতে নৌকা ডুবে নিখোঁজ দুই শিক্ষার্থীর সন্ধান মেলেনি। ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামে আজকের এইচএসসি ও আলিম পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। নোয়াখালী জেলা শহরে জলাবদ্ধতায় আটকে আছে মানুষ। মৌলভীবাজারে ফের বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সুনামগঞ্জে স্থিতিশীল রয়েছে নদীর পানি। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত।
সিলেট ও গোলাপগঞ্জ: সিলেটে টানা বৃষ্টির ফলে নদ-নদীর পানি বেড়ে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নগরীর নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফলে চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সিলেটে পাঁচটি নদীর পানি ছয়টি স্থানে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সিলেটে সোয়া ৩শ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এক মাসের মধ্যে সিলেট তৃতীয়বার বন্যার কবলে পড়েছে। দ্বিতীয় দফার বন্যায় ৭ লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি। রোববার রাত থেকে শুরু মঙ্গলবার পর্যন্ত সিলেটে থেমে থেমে ও উজানে ভারি বৃষ্টির ফলে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার যেসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছিল সেই এলাকা ফের প্লাবিত হয়েছে। গোলাপগঞ্জে গত সোমবার বন্যার পানিতে ডুবে রাব্বি আহমেদ (৪) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে উপজেলার বাদেপাশা ইউনিয়নের কোনাগাও গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে।
সুনামগঞ্জ: জেলায় সোমবার রাতে প্রবল বৃষ্টি হলেও মঙ্গলবার সকাল থেকে রোদ থাকায় সুরমাসহ সবকটি নদ-নদীতে ধীরে ধীরে পানি হ্রাস পাচ্ছে। সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বেলা ৩টায় তা ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলার অপর নদীগুলোতেও অনুরূপভাবে পানি হ্রাস পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
বৃষ্টিপাত কম হলে নদ-নদীর পানি দ্রুত হ্রাস পাবে বলে জানিয়েছে পাউবো কর্তৃপক্ষ। পানি বাড়ায় জেলা শহরের সঙ্গে তাহিরপুর দোয়ারাবাজার উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
মৌলভীবাজার, বড়লেখা ও কুলাউড়া: নদী ও হাওড়ে পানি বাড়ছে। চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন এজেলার তিন লক্ষাধিক পানিবন্দি মানুষ। সম্প্রতি পানি কিছুটা কমলে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে চলে যান। সোমবার ও মঙ্গলবার পানি বাড়ায় ফের তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে হচ্ছে। মানুষের সঙ্গে একইভাবে বিপাকে পড়েছে এ জেলার গবাদিপশুও।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, জেলার মনু, কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার বেলা ৩টার তথ্য অনুযায়ী মনু নদীতে ১৯ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদীতে ২০ সেন্টিমিটার ও জুড়ী নদীতে ১৮২ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানি অতিবাহিত হচ্ছে।
নেত্রকোনা ও কলমাকান্দা: কলমাকান্দায় উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। উব্দাখালী নদী ছাড়াও উপজেলার গণেশ্বরী, মহাদেও, বাখলা, মঙ্গেলশ্বরী ও বৈঠাখালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশকিছু গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে বন্যার পানি উঠছে। এতে লোকজনের মধ্যে আবারও বন্যার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এছাড়া জেলার কংস, সোমেশ্বরী, ধনুসহ সবকটা নদ-নদীর পানি অব্যাহতভাবে বাড়ছে।
শেরপুর ও নালিতাবাড়ী : শেরপুরের চেল্লাখালী, মহারশি, সোমেশ্বরী ও ভোগাই নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান জানান, নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই নদীর পানি মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার এবং চেল্লাখালি নদীর পানি ৩৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি ও সোমেশ্বরী নদীতে পানি পরিমাপক মিটার গেজ না থাকায় তা বিপৎসীমার কত সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তা বলা যাচ্ছে না। তবে ওই নদী দুটির পানি মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
নির্বাহী প্রকৌশলী আরও জানান, পাহাড়ি ঢলের পানির প্রবল চাপে ঝিনাইগাতীর খইলকুড়া এলাকায় এবং নালিতাবাড়ীর সন্ন্যাসীর ভিটা এলাকায় নদীর তীরবর্তী বাঁধ ভেঙেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ হুমায়ুন কবির জানান, গত ২ দিনে শেরপুর জেলায় ৫৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার ৪০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে নিচু এলাকার বিভিন্ন সবজি ও বীজতলাগুলো পানির নিচে ডুবে গেছে। ঢলের পানিতে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমনের বিজতলা।
ঝিনাইগাতী উপজেলার বাজার সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে দিঘিরপাড় এলাকায় মহারশি নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রিত বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি গড়িয়ে আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ির আলুটিলায় সাপমারা এলাকায় পাহাড় ধসে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে প্রায় ৫ ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আটকা পড়ে বহু যানবাহন। মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে এই ঘটনা ঘটে।
আটকা পড়া যাত্রীরা জানান, ভোরে সাপমারা এলাকায় পাহাড়ের মাটি ধসে যাওয়ায় পর ফায়ার সার্ভিস মাটি সরানোর কাজ শুরু করে। সকাল ১০টা থেকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
এ ছাড়া দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেড কোয়ার্টার এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ডুবে গেছে মেরুং বাজার। টানা বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়ন ও কবাখালি ইউনিয়নে ২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। টানা বর্ষণের কারণে মাইনী নদীর পানি বেড়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
খাগড়াছড়ি সাজেক সড়কের কবাখালি, বাঘাইহাট ও মাচালং এলাকায় পানি উঠে যাওয়ায় সাজেকের সঙ্গে সারা দেশে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে সাজেক রুইলুই পর্যটন কেন্দ্রে আটকা পড়েছেন ৪৬৫ পর্যটক।
সিন্দুকছড়ির ধুমনিঘাট কাটাপাহাড় এলাকায় সড়ক দেবে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে সড়ক দেবে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মাকসুদুর রহমান।
বান্দরবান: সাঙ্গু-মাতামুহুরী নদীর পানি অস্বাভাবিক বেড়েছে। নদী তীরবর্তী লোকজন সরে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। তবে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় অব্যাহত বর্ষণে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে জেলায়।
অপরদিকে মঙ্গলবার সকালে রুমা-থানচি, রোয়াংছড়ি সড়কে ধসে পড়া পাহাড়ের মাটি রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলায় অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। তবে বৃষ্টিতে সাঙ্গু নদীর স্রোতে থানচিতে নৌকা ডুবে নিখোঁজ হওয়া ২ শিক্ষার্থীর খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
রাঙামাটি: বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা। প্লাবিত হয়ে পড়েছে সদরের উপজেলা পরিষদ ভবনসহ নিম্নাঞ্চলের জনপদ। তলিয়ে গেছে বাঘাইছড়ি-বাঘাইহাট-সাজেক সড়ক ও বেইলি ব্রিজ। ফলে বাঘাইছড়ি ও সাজেকের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্তত শতাধিক পর্যটক আটকা পড়েছেন।
দুর্গতদের নিরাপত্তায় আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে উপজেলা প্রশাসন। নিরাপদ স্থানে চলে যেতে মাইকিং করে প্রচার করা হচ্ছে সতর্কবার্তা। জরুরি মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দিতে উপজেলায় মোট ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিরীন আক্তার।
মীরসরাই (চট্টগ্রাম): ডুবে গেছে মীরসরাই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট ও রোপা আউশ। মঙ্গলবার (২ জুলাই) বিকাল নাগাদ অনেক এলাকার রস্তাঘাট এখনো পানির নিচে রয়েছে। এখনো বড় ধরনের ক্ষতি না হলে ও বর্ষণ অব্যাহত থাকলে বাড়তে পারে ক্ষয়ক্ষতি।
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) : দেওয়ানগঞ্জ পোল্যাকান্দি সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়ক ধসে গেছে, ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়েছে। সরদারপাড়া সড়কে প্রায় ৩০ ফুটের মতো বড় গর্ত ও পাশে আরও কয়েকটি গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
ফেনী : মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের তিন স্থানে ভেঙে চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
নোয়াখালী: জেলা শহরে জলাবদ্ধতায় আটকে আছে মানুষ। ডুবে গেছে জেলা শহরের প্রায় প্রতিটি সড়ক, কাঁচা বাড়ি ছাড়াও পাকা বাসাবাড়িতেও ঢুকছে পানি। বাদ যায়নি সরকারি অফিস।
Leave a Reply