আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত সোমবার এক ঐতিহাসিক রায়ে ঘোষণা করেছে যে, পূর্বতন প্রেসিডেন্টরা তাদের কর্মকালীন সময়ে কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য দায়মুক্তি ভোগ করবেন। এই রায়ের ফলে ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয় উল্টে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে মনে করা হচ্ছে।
আদালত ৬-৩ ভোটে রায় দিয়েছে যে পূর্বতন প্রেসিডেন্টরা তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতার আওতায় গৃহীত কর্মকাণ্ডের জন্য দায়মুক্তি ভোগ করলেও, ব্যক্তিগত ক্ষমতায় গৃহীত কর্মকাণ্ডের জন্য দায়মুক্তি পাবেন না।
এই রায়ের ফলে প্রথমবারের মতো আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত ঘোষণা করেছে যে কিছু ক্ষেত্রে পূর্বতন প্রেসিডেন্টরা ফৌজদারি অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেতে পারেন।
২০২০ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে পরাজয়ের পর ফলাফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টার জন্য ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যেসব ফেডারেল অভিযোগ আনা হয়েছে, এই রায় সেই সব মামলায় ট্রাম্পের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করবে। এছাড়াও জর্জিয়ায় নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে যে রাজ্য-স্তরের মামলা চলছে, সেখানেও এই রায়ের প্রভাব পড়তে পারে।
ট্রাম্প তাৎক্ষণিকভাবে এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সংবিধান এবং গণতন্ত্রের জন্য এটি একটি বিরাট জয়। একজন আমেরিকান হতে পেরে আমি গর্বিত।’
আদালতের ছয় জন বিচারপতির রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস এই ঐতিহাসিক রায়ের ঘোষণা দেন। আদালতের তিন জন উদারপন্থী বিচারপতি এই রায়ের বিরোধিতা করেছেন।
সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা তাদের রায়ে বলেন, পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের তাদের কর্মকালীন সময়ের সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য বিচারের মুখে পাঠালে রাজনৈতিক প্রতিশোধ এবং স্বৈরাচারিতার দরজা খুলে যাবে।
তারা লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট তার অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের জন্য কোন দায়মুক্তি ভোগ করেন না এবং প্রেসিডেন্ট যা কিছু করেন তা সবই সরকারি কর্মকাণ্ড নয়। প্রেসিডেন্ট আইনের উপরে নন। তবে সংবিধানের আওতায় কার্যনির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব পালনার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের আচরণকে কংগ্রেস অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করতে পারে না।’
তারা জোর দিয়ে বলেন, এই দায়মুক্তি শুধুমাত্র ট্রাম্পের জন্য নয়, বরং ‘রাজনীতি, নীতি অথবা দল নির্বিশেষে ওভাল অফিসের সকল অধিবাসীর জন্য’।
রায়ের পক্ষে যে ছয় জন বিচারপতি ভোট দিয়েছেন, তাদের মধ্যে তিন জনকেই নিয়োগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প নিজে।
উদারপন্থী বিচারপতি সোনিয়া সোতোমায়র সোমবার সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, এই রায় কার্যকরভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারকে বৈধতা দান করছে।
তিনি লিখেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দেশের, এমনকি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি। সংখ্যাগরিষ্ঠের যুক্তি অনুসারে, যখন তিনি তার সরকারি ক্ষমতা যেকোনো ভাবে ব্যবহার করবেন, তখন তিনি ফৌজদারি মামলা থেকে সুরক্ষিত থাকবেন।’
‘তিনি কি নৌবাহিনীর সিল টিম ৬ কে কোন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করার জন্য আদেশ দিচ্ছেন? দায়মুক্ত। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি কি সামরিক অভ্যুত্থানের আয়োজন করছেন? দায়মুক্ত। তিনি কি ক্ষমা করার বিনিময়ে ঘুষ নিচ্ছেন? দায়মুক্ত। দায়মুক্ত, দায়মুক্ত, দায়মুক্ত।’
সোমবার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন বেশ কিছু ডেমোক্র্যাট নেতা। প্রগতিশীল কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ এই রায়কে ‘আমেরিকান গণতন্ত্রের উপর হামলা’ বলে অভিহিত করেছেন।
নিম্ন আদালতের কাছে পাঠানো হলো মামলা
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ফলে ২০২০ সালের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে ফেডারেল মামলা চলছে, তা আবার নিম্ন আদালতে পাঠানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই মামলার কার্যক্রম বন্ধ ছিল ট্রাম্পের দায়মুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত।
সর্বোচ্চ আদালত ট্রাম্পের নির্বাচন সংক্রান্ত সমস্ত আচরণকে ‘সরকারি’ নাকি ‘ব্যক্তিগত’ তা স্পষ্ট করে না বললেও, তারা রায় দিয়েছেন যে ন্যায়বিভাগের আধিকারিকদের সঙ্গে ট্রাম্পের আলোচনা মামলা থেকে সুরক্ষিত।
মার্কিন কারাগার তদন্তকারীরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি ‘ন্যায় বিভাগের ক্ষমতা ও প্রাধিকার ব্যবহার করে ভোট জালিয়াতির ভুয়া তদন্ত চালিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন রাজ্যে এমন চিঠি পাঠিয়েছিলেন যেতে ভুল ভাবে দাবি করা হয়েছিল যে ন্যায় বিভাগ নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করতে পারে এমন গুরিব্তর সমস্যার প্রমাণ পেয়েছে’।
তবে আদালত রায় দিয়েছে যে ন্যায় বিভাগের আধিকারিকদের সাথে ট্রাম্পের আলোচনা সংক্রান্ত অভিযোগের ক্ষেত্রে তিনি ‘সম্পূর্ণরূপে দায়মুক্ত’।
সর্বোচ্চ আদালতের রায় ট্রাম্পের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না, তা নির্ধারণ করতে সময় লাগবে। এই কারণে মামলার বিচারকার্য আরও বিলম্বিত হতে পারে এবং রায় আসতে পারে নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে, যখন ট্রাম্প আবার বাইডেনের মুখোমুখি হবেন।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক মাইক হান্না বলেন, সোমবারের রায়ের পর ফেডারেল নির্বাচন সংক্রান্ত মামলার বিচারক ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ বজায় থাকবে তা চূড়ান্ত ভাবে নির্ধারণ করবেন।
হান্না বলেন, ‘এই মামলাটি আবার ডিসি জেলা আদালতের বিচারক তানিয়া চুটকানের কাছে যাবে, যিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো একের পর এক পরীক্ষা করে দেখবেন যে কোনগুলো সরকারি কর্মকাণ্ডের আওতায় পড়ে এবং কোনগুলো ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের আওতায় পড়ে।’
ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পকে গণতন্ত্রের জন্য একটি হুমকি হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। তারা বলছেন, ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়ার জন্য ট্রাম্পের চেষ্টার পরিণতিতেই ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে তার সমর্থকদের দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল।
অন্যদিকে, চার সেট ফৌজদারি অভিযোগের মুখে থাকা ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন যে বাইডেন তার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ট্রাম্প হলেন আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম পূর্বতন রাষ্ট্রপতি যাকে ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গত মে মাসের শেষের দিকে, ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ‘চুপ থাকার’ জন্য অর্থ প্রদানের মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
Leave a Reply