সংবাদমাধ্যম জগতে এখন অস্বাভাবিক বাড়বাড়ন্ত অনলাইন নিউজ পোর্টালের। টেলিভিশন স্টেশন বা সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠায় যে বিপুল পুঁজি প্রয়োজন, সাধারণ মানের অনলাইন নিউজ পোর্টালে তা নয়। রাতারাতি নিউজ পোর্টাল গজিয়ে ওঠার সম্ভবত এটি অন্যতম কারণ। এছাড়া হাতের মুঠোয় প্রযুক্তি চলে আসাও নতুন এই সংবাদমাধ্যম বিকাশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
সীমিত জনগোষ্ঠীর এই দেশে শত শত নিউজ পোর্টাল টিকে থাকবে না-বিশেষজ্ঞ না হয়েও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বিলুপ্ত হবে বা ধুঁকে ধুঁকে অস্তিত্ব জানান দেবে অধিকাংশ অনলাইন। এমন সময়ে দৈনিক মানবাতার কন্ঠের যাত্রায় দ্বিস্তরের কামনা-প্রথমত, টিকে থাকুক নিউজ পোর্টালটি এবং দ্বিতীয়ত, জনচাহিদা পূরণের মাধ্যমে অধিকার করুক এ জগতের শীর্ষস্থান।
ওয়েবভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের আবির্ভাবের পূর্বে সংবাদ জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল খবরের কাগজ ও টেলিভিশনের; কিছুটা রেডিওরও। এই তিনটি মাধ্যম মানুষের যে প্রয়োজন মেটাতে পারছিল না, তা পূরণে অনেকাংশে সক্ষম হয়েছে নিউজ পোর্টাল। বিশেষত খবর আপডেটে নিউজ পোর্টালের জুড়ি নেই। গতিময় নাগরিক জীবনে তাই এখন জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম নিউজ পোর্টাল।
এই উপমহাদেশে কবে সংবাদমাধ্যমের যাত্রা শুরু হয়েছে তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে মধ্যযুগে ভারতবর্ষে হাতেলেখা সংবাদপত্র ছিল। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে কাফি খান নামে এক পণ্ডিত তার ‘মুন্তা-খাবুল-লুবাব’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘শিবাজীর বাড়ির জনৈক রাজারামের মৃত্যুর খবর সম্রাটের শিবিরে পৌঁছেছিল সংবাদপত্রের মাধ্যমে।’ (সুধাংশু শেখর রায় : সাংবাদিকতা সাংবাদিক ও সংবাদপত্র)। বলা দরকার, মুদ্রণযন্ত্র তখনও তৈরি হয়নি।
ভারতে মুদ্রণযন্ত্র এসেছিল পর্তুগিজদের হাত ধরে। তবে মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার করে সংবাদপত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল ইংরেজদের হাতে। ১৭৮০ সালের জানুয়ারি মাসে জেমস হিকি নামে এক ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশ করে এ ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। এর ৩৮ বছর পর ১৮১৮ সালের এপ্রিলে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা ‘দিগদর্শন’ নামে একটি মাসিক বাংলা পত্রিকা এবং পরের মাসে ‘সমাচার-দর্পণ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। (গোলাম মুরশিদ : হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি)।
প্রথম দিককার সংবাদপত্রগুলো খুব বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল বলে জানা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রথম ব্যতিক্রম ‘অমৃতবাজার’। যশোরের কৃতী ভ্রাতৃদ্বয় বসন্তকুমার ঘোষ ও শিশিরকুমার ঘোষ ঝিকরগাছার পলুয়া মাগুরা গ্রাম থেকে ১৮৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি বের করেন। ১৮৭১ সালে এটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। (সংস্থাপন মন্ত্রণালয় : বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার)।
এরপর কলকাতা এবং ঢাকাসহ তৎকালীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো থেকে প্রকাশিত অনেক পত্রিকা জনমানুষের স্বার্থের অনুকূলে অবস্থান নিয়ে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। রেখেছে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আবার দায়িত্বশীলতার সাথে সংবাদ পরিবেশনে ব্যর্থ হওয়াসহ নানাবিধ কারণে হারিয়ে গেছে শত শত পত্রিকা।
মানুষকে খবর জানানো ও খবর বিশ্লেষণে দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে মুদ্রিত সংবাদপত্র। টেলিভিশনের আবির্ভাব এই একাধিপত্য খানিকটা খর্ব করলেও পুরোপুরি পারেনি। এক সময় অনেকে ধারণা করেছিলেন, চলমান ছবিসহ খবর পরিবেশনা মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিলুপ্তি ঘটাবে। কিন্তু এই ধারণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের সংখ্যা কম নয়।
এমন বাস্তবতায় একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিকশিত হতে শুরু করে ওয়েবভিত্তিক নিউজ পোর্টাল। ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন এই সংবাদমাধ্যমকে দ্রুত জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। নিউজ পোর্টালের কল্যাণে মানুষ এখন বাসা, অফিস তো বটেই, চলতি পথেও জেনে নিতে পারছেন দেশ-বিদেশের সর্বশেষ সংবাদ। পোর্টালগুলোতে থাকছে খবরের বিশ্লেষণও। সুযোগ রয়েছে যে কোনো খবরের ব্যাপারে মন্তব্য করারও।
ফলে সত্যিকারভাবেই মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে নিউজ পোর্টাল। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হাতগুটিয়ে বসে নেই সনাতনী সংবাদপত্রগুলোও। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারাও খুলছে অনলাইন ভার্সন।
দিন যাচ্ছে আর তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে। বলা যেতে পারে, অন্য যে কোনো সেক্টরের চেয়ে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে দ্রুত ও বহুমুখী ধারায়। ফলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সামনের দিনগুলোতে প্রযুক্তি সংবাদমাধ্যমের জন্য আরও নতুন নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে। এ সুযোগ যোগ্যতার সাথে কাজে লাগাতে পারলে নিউজ পোর্টাল হয়ে উঠতে পারে একক নেতৃত্বদানকারী সংবাদমাধ্যম।
এ সময়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দলবাজি। ঘটনাগুলো পরস্পরবিরোধী সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে বর্ণিত ও প্রদর্শিত হয়। এতে কিছু পাঠক বিভ্রান্ত হলেও সংবাদমাধ্যমগুলোর চরিত্র কিন্তু বেশিরভাগ পাঠক ঠিকই ধরতে পারেন। তবে সমস্যা হলো, পাঠকের সামনে বিকল্প কম।
কর্পোরেট পুঁজির দাসত্ব সংবাদমাধ্যমের জন্য আরেক বিপদ। গত এক দশকে গণমাধ্যমের মালিকানার ধরন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন আর কোনো ব্যক্তি বা একক সংস্থা নয়, মালিক হচ্ছে কোনো ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা গ্রুপ অব কোম্পানিজ। গণমাধ্যম নিজেই পরিণত হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিতে।
মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো দেশের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কব্জায়, যাদের অনেকেই আবার ভয়ানকভাবে বিতর্কিত। ফলে এগুলো জনস্বার্থ পূরণে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে অবস্থান নিচ্ছে জনস্বার্থের বিপরীতে।
নোয়াম চমস্কির মতে, গণমাধ্যম কাজ করে এলিটদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে। (ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট : দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য ম্যাস মিডিয়া)। শুধু এটুকু হলেও দুশ্চিন্তার খুব বেশি কারণ ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম আরেক দফা বাড়া। এখানকার অনেক মিডিয়ার বিরুদ্ধে তথ্যসন্ত্রাসের গুরুতর অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা নিখাদ সত্য।
এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে, মানসম্মত সংবাদমাধ্যম, তা সে সংবাদপত্র, টেলিভিশন কিংবা নিউজ পোর্টাল যাই হোক না কেন, প্রতিষ্ঠায় প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। সেই বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যদি তার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল বা অবৈধ ব্যবসার দ্রুত প্রসার ঘটাতে চান, তাহলে তা সত্যিকার গণমাধ্যম হয়ে ওঠার জায়গা থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য।
বর্তমান সময়ে গণআকাঙ্ক্ষা পূরণে সংবাদমাধ্য মজগতে যে শূন্যতা রয়েছে তা পূরণ হওয়া জরুরি। একমাত্র সৎ উদ্যোক্তা, জনগণের প্রতি যিনি দায়বোধ করেন, তার পক্ষেই এই শূন্যতা পূরণ সম্ভব।দৈনিক মানবাতার কন্ঠের বহুল প্রত্যাশিত এই পথে হাঁটলে সাফল্য সুনিশ্চিত। নিশ্চয় মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করবেন বিষয়টি নিউজ পর্টালের লাখো পাঠক।
প্রতিবেদকঃ কায়েশ ইবনে আনোয়ার।
Leave a Reply