মানবতার কন্ঠ ডেস্ক: ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ঈদুল আজহা আজ। মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা উদযাপন করা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজরত ইবরাহিমের (আ.) সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের অনুপম আদর্শ অনুসরণ করে সারা বিশ্বের মুসলমানরা এই ঈদে পশু কোরবানি করেন। কোরবানিই ঈদুল আজহার প্রধান আনুষ্ঠানিকতা।
হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসাসহ মনের পশুত্বকে পরাভূত করার শিক্ষা নিয়ে আসে ঈদুল আজহা, যা কোরবানির ঈদ হিসেবেও আমাদের কাছে পরিচিত। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে শত ভোগান্তি সয়ে হলেও রাজধানীসহ বড় শহরের মানুষ ফিরেছেন গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের কাছে। ঈদের আগে কোরবানির পশু কেনার পর তার পরিচর্যা করার মাধ্যমে বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে যে আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়, রাজধানীসহ সারা দেশেই তা দৃশ্যমান।
ঈদুল আজহায় সামর্থ্যবান মুসলিমদের জন্য পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। হজরত ইবরাহিম (আ.) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার বৃদ্ধ বয়সে হওয়া প্রাণপ্রিয় ছেলে হজরত ইসমাঈলকে (আ.) কোরবানি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে, আল্লাহর অশেষ রহমতে হজরত ইসমাঈলের (আ.) পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। হজরত ইবরাহিমের (আ.) সেই ত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ১০ জিলহজ পশু কোরবানি করে থাকেন। ঈদের পরও দুই দিন পশু কোরবানি দেওয়া যায়।
ঈদের নামাজের খুতবায় কোরবানির তাৎপর্য তুলে ধরা হবে। ‘আল্লাহর দরবারে কোরবানির গোশত ও রক্ত কোনো কিছুই পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তোমাদের তাকওয়া’—কোরআনের এ বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে ত্যাগই কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা।
ঈদগাহ ও মসজিদে দুই রাকাত নামাজ শেষে সমাজ, দেশ, মুসলিম উম্মাহ তথা সারা বিশ্বের শান্তি ও কল্যাণ কামনায় দোয়া করা হবে। জামাত শেষে কোলাকুলি করে প্রকাশ করা হবে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা। ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরে সামর্থ্যবান মুসলমানরা পশু কোরবানি করবেন। ধর্মীয় নির্দেশনা অনুযায়ী মাংস ভাগ করে দেওয়া হবে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অসহায় মানুষের মধ্যে।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশবাসীসহ বিশ্বের সব মুসলমানকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানিয়ে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বাণীতে বলেছেন, ‘কোরবানি আমাদের মাঝে আত্মদান ও আত্মত্যাগের মানসিকতা সঞ্চারিত করে। আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মনোভাব জাগ্রত করে এবং সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়।’
কেউ যাতে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়, সে লক্ষ্যে সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে এবং তাদের পাশে দাঁড়াতে রাষ্ট্রপতি দেশের বিত্তবান ও সচ্ছল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।
এদিকে, ঈদুল আজহার ত্যাগের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঈদুল আজহার আগে রোববার (১৬ জুন) তিনি দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানাতে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী, আসসালামু আলাইকুম,এক বছর পর আবারো আমাদের জীবনে ফিরে এসেছে পবিত্র ঈদুল-আজহা। আমি আপনাদের সবাইকে ঈদুল-আজহার শুভেচ্ছা জানাই। ঈদ মোবারক।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আসুন ঈদুল আজহার শিক্ষা গ্রহণ করে ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা সকলে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করি।’
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় ঈদগাহ, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ রাজধানীতে ১৮৪টি ঈদগাহ ও প্রায় দেড় হাজার মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করবেন মুসল্লিরা।
ঈদের প্রধান জামাত জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে:
রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে ঈদের প্রধান জামাত হবে সকাল সাড়ে ৭টায়। সেখানে প্রায় ৩৫ হাজার মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করবেন। সে লক্ষ্যে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)।
জাতীয় ঈদগাহে ঈদুল আজহার নামাজে ইমামতি করবেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমিন।
জানা গেছে, জাতীয় ঈদগাহে প্রায় ২৫০ জন অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও ৮০ জন গুরুত্বপূর্ণ নারী জামাতে অংশ নেবেন। এছাড়া, প্রায় ৩৫ হাজার সাধারন মুসল্লি এ জামাতে অংশ নেবেন।
ডিএসসিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঈদগাহ মাঠে ১০টি এয়ার কুলারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত ফ্যান ও লাইটের ব্যবস্থা আছে। পাশাপাশি খাবার পানি, ভিআইপি কাতারে জায়নামাজ, ভ্রাম্যমাণ টয়লেট, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা এবং বৃষ্টির পানিনিরোধক সামিয়ানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় ঈদগাহে ভিআইপি, নারী ও পুরুষের প্রবেশের জন্য আলাদা তিনটি গেট করা হয়েছে।
আরও জানা গেছে, জাতীয় ঈদগাহে ভিআইপি পুরুষ কাতার হবে ৫টি, ভিআইপি নারী কাতার হবে ১টি, জনসাধারণের মধ্যে পুরুষ কাতার ৬৫টি ও নারী কাতার ৫০টিসহ ১২১টি কাতার হবে। জাতীয় ঈদগাহে অজুখানায় একসঙ্গে ১১৩ জন পুরুষ ও ২৭ জন নারীসহ ১৪০ জন অজু করতে পারবেন।
রোববার সকালে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, ঈদগাহ ও এর আশপাশের এলাকায় এসবির ইকুইপমেন্ট ও ডিএমপির ডগ স্কোয়াড দিয়ে সুইপিং করা হবে। পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ, ড্রোন পেট্রোলিং ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। সেইসঙ্গে মেটাল ডিটেক্টর ও আর্চওয়ের মাধ্যমে তল্লাশি করা হবে।
এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, ইউনিফর্মড পুলিশ ছাড়াও ডিবি, এসবি ও অন্য সংস্থার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। কোনো দাহ্য বস্তু নিয়ে ঈদের জামাতে আসা যাবে না।
জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কা নেই, জানিয়ে তিনি বলেছেন, এরপরও ডিএমপি পুরো বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করেছে।
বিকল্প ব্যবস্থা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে:
প্রতিকূল আবহাওয়া বা অন্য কোনো কারণে জাতীয় ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করা সম্ভব না হলে রাষ্ট্রপতি সকাল ৮টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঈদের নামাজ আদায় করবেন। রাষ্ট্রপতি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ জামাতে অংশ নেবেন।
প্রতি বছরের মতো এবারও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ আদায়ে পাঁচটি জামাত করা হবে। প্রথম জামাত হবে সকাল ৭টায়। দ্বিতীয়টি সকাল ৮টায়, তৃতীয়টি সকাল ৯টায়, চতুর্থটি সকাল ১০টায় এবং পঞ্চম ও সর্বশেষ ঈদের জামাত হবে বেলা পৌনে ১১টায়।
প্রথম জামাতে ইমামতি করবেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা ইহসানুল হক। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সাবেক মুয়াজ্জিন হাফেজ মো. আতাউর রহমান। এরপর সকাল ৮টার দ্বিতীয় জামাতে ইমামতি করবেন বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মাওলানা মুহীউদ্দিন কাসেম। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম মো. আবদুল হাদী।
সকাল ৯টার তৃতীয় জামাতে ইমামতি করবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফাসসির মাওলানা আবু সালেহ পাটোয়ারী। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম মো. জসিম উদ্দিন।
সকাল ১০টায় চতুর্থ জামাতে ইমামতি করবেন মিরপুরের মহতামিম জামেয়া আরাবিয়ার মুহতামিম মাওলানা সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম রুহুল আমিন।
বেলা পৌনে ১১টার সর্বশেষ জামাতের ইমামতি করবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। মোকাব্বির থাকবেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খাদেম মো. আক্তার মিয়া। পাঁচটি জামাতের কোনোটিতে একজন ইমাম অনুপস্থিত থাকলে বিকল্প ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন হাইকোর্ট মাজার মসজিদের ইমাম মাওলানা আশরাফুল ইসলাম।
ঢাকার আরও কিছু ঈদ জামাতের খোঁজ-খবর:
জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজের জামাত সকাল সাড়ে ৮টায় হবে। জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ, হুইপ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মচারীসহ সাধারণ মুসল্লিরা এতে অংশ নেবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে দুটি ঈদের জামাত হবে। প্রথম জামাত সকাল ৮টায় এবং দ্বিতীয় জামাত সকাল ৯টায় হবে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল মসজিদে সকাল ৭টায়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে সকাল ৮টায় ও ফজলুল হক মুসলিম হলের পূর্ব পাশের খেলার মাঠে সকাল ৮টায় জামাত হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) খেলার মাঠে সকাল ৭টায় ঈদের জামাত হবে। আজিমপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার বায়তুন নূর জামে মসজিদে জামাত হবে সকাল ৮টায়।
পুরান ঢাকার লালবাগ শাহী মসজিদে ঈদ জামাত সকাল ৮টা ও ৯টায়। আজিমপুর ছাপরা মসজিদে সকাল সাড়ে ৭টায়, সাড়ে ৮টায় ও সাড়ে ৯টায় হবে। কবরস্থান মসজিদে সকাল ৭টায়, ৮টায়, ৯টায় ও ১০টায় পরপর হবে চারটি জামাত হবে।
গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ অ্যান্ড ঈদগাহে তিনটি জামাত হবে। প্রথম জামাত সকাল ৬টায়, দ্বিতীয় জামাত সকাল সাড়ে ৭টায় এবং তৃতীয় জামাত ৯টায় হবে। ধানমন্ডির সোবহানবাগ মসজিদে সকাল ৮টায়, ধানমন্ডির ৩ নম্বর রোডের এনায়েত মসজিদে সকাল সাড়ে ৭টায়, ৭ নম্বর রোডের বাইতুল আমান মসজিদে সকাল ৮টায়, ১২/এ রোডের তাকওয়া মসজিদে সকাল ৮টায় ঈদের জামাত হবে।
মিরপুর-১২ এর হারুন মোল্লাহ ঈদগাহ, পার্ক ও খেলার মাঠে সকাল ৭টায় এবং রাজধানীর পল্লবী থানার ২ নম্বর ওয়ার্ডের হারুন মোল্লাহ ঈদগাহ মাঠে সকাল ৭টায় ঈদের জামাত হবে।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মারকাজুল ফিকরিল ইসলামিতে সকাল ৭টায়, বসুন্ধরা সি ব্লকের উম্মে কুলসুম জামে মসজিদে ৭টা ১৫ মিনিটে, এফ ব্লক জামে মসজিদে সকাল সাড়ে ৭টায়, জি ব্লকের বায়তুল জান্নাত জামে মসজিদে সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে, কে ব্লকের মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসায় ৭টা ৪৫ মিনিটে এবং এন ব্লকের ফকিহুল মিল্লাত জামে মসজিদে সকাল ৮টায় ঈদের জামাত হবে।
Leave a Reply